মশিউল আলম, প্রথম আলো:
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি গত রোববার সামরিক উর্দি গায়ে চাপিয়ে রাজধানী বাগদাদ থেকে উড়ে গিয়েছিলেন তাঁর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর এই প্রথম তিনি ওই শহরে পা রাখতে সক্ষম হলেন। এর আগে মসুলের ধারেকাছেও তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, গত রোববারের আগ পর্যন্ত শহরটির ওপর তাঁর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না; ওখানে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ‘খিলাফতের’ কালো পতাকা উড্ডীন ছিল। ২০১৪ সালের ২৯ জুন আইএস যোদ্ধারা মসুল শহর ও তার চারপাশ থেকে ইরাকের সরকারি বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করে সেখানে তাঁদের খিলাফতের পতাকা উড়িয়েছিলেন।
কোনো কোনো হিসাবে বলা হয়ে থাকে, আইএসের মাত্র হাজার দেড়েক যোদ্ধার আক্রমণের ধাক্কায় ইরাকি সরকারি সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্য অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ও ইউনিফর্ম খুলে সেদিন মসুল ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকে আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন আইএস যোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল।
আইএসের মসুল বিজয় সংগঠনটির যোদ্ধাদের কাছে ছিল এক অলৌকিক ব্যাপার। তাঁদের মুখপত্র দাবিক ম্যাগাজিনের একাধিক লেখায় দেখেছি, তাঁরা বিশ্বাস করতেন, মসুল বিজয়ের যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে ফেরেশতারা ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ফেরেশতারা তাঁদের পক্ষে যুদ্ধ না করলে এত অল্পসংখ্যক যোদ্ধার পক্ষে ইরাকি সেনাবাহিনীর অর্ধলক্ষ সৈন্যকে ওভাবে পযুর্দস্ত করা সম্ভব ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইএসের অনুসারী তরুণ-যুবকেরাও সম্ভবত এই বিশ্বাসে পৌঁছেছিলেন যে, সিরিয়া-ইরাকে আইএসের ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার জিহাদে সৃষ্টিকর্তা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন। প্রধানত এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়েই তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে সিরিয়ায় ‘হিজরত’ করেছিলেন। এই বিশ্বাসের জোরেই আইএসের যোদ্ধারা সিরিয়া ও ইরাকের রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে উভয় দেশের অন্তত ১৫টি বড় শহরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের ‘খিলাফতে’র অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন। একপর্যায়ে তাঁদের অধিকৃত এলাকার আয়তন দাঁড়ায় গ্রেট ব্রিটেনের আয়তনের সমান। ইসলামিক স্টেট সত্যিই একটা রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল, যার রাজধানী বা প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল (এখনো আছে), সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিল, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা, শাসন পরিচালনা, বিচারব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদি ছিল। গবেষকদের কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী।
অবশ্য আইএসের এই ‘মিরাকুলাস মিলিটারি সাকসেস’ বা অলৌকিক সামরিক সাফল্যের পেছনেতথাকথিত ইমানের জোর বা জিহাদি–স্পৃহার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সাদ্দামের পতনের পর ইরাকি সরকারি সামরিক বাহিনীর ভেঙে পড়া, সিরিয়ায় বাশার সরকারকে উৎখাতের সহিংস প্রয়াস ও তার ফলে গৃহযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, বিশেষত সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্ব, শিয়া-সুন্নি-কুর্দি-আলাভি-বেদুইন ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীগত ভেদাভেদ, জ্বালানি তেল ও অস্ত্রের চোরাই অর্থনীতি; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি ও কথিত অঘোষিত গোপন ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি।
অনেক পর্যবেক্ষক ও গবেষক সন্দেহ করেন, আইএসের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, কাতার প্রভৃতি দেশের প্রত্যক্ষ হাত ছিল। কেউ কেউ বলেন, আইএস ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা কোনো দিন ইসরায়েলে কোনো হামলা করেনি, যারা আসলে ইসলাম ধর্মের ক্ষতি করার জন্যই আবির্ভূত হয়েছে। অবশ্য এসব অভিযোগের সমর্থনে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করেন, সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটানোসহ সিরিয়া-ইরাকের রাজনৈতিক ভূগোল বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আইএসকে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু একপর্যায়ে আইএস তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে; সংগঠনটি সৌদি আরবের জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে। তাই আইএস অবশেষে সৌদি-মার্কিন মদদ হারিয়ে ফেলেছে; যখন এটা ঘটেছে তার কিছু পর থেকেই আইএসের অধিকৃত এলাকা হারানো শুরু হয়েছে এবং সংগঠনটি ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে ক্রমেই চূড়ান্ত পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
গত রোববার ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি মসুলে গিয়েছিলেন আইএসের ‘খিলাফতের’ আংশিক পতন উদ্যাপন করতে। তাঁর সেনাবাহিনী পশ্চিম মসুলের পুরোনো অংশের কয়েকটি গলি থেকে সর্বশেষ আইএস যোদ্ধাদের বিতাড়িত করার মধ্য দিয়ে ইরাকে ইসলামিক স্টেটের পরাজয় চূড়ান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাদি এ জন্য তাঁর বাহিনীর সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ইরাকে ইসলামিক স্টেটের ‘ধোঁকারাজ্যের’ (স্টেট অব ফলসহুড) পতন ঘটেছে। সত্যিকার অর্থে এর পরে আর ইরাকি ভূখণ্ডের ভেতরে ইসলামিক স্টেটের অধিকৃত বা নিয়ন্ত্রিত কোনো এলাকা রইল না। তবে দেশটির পশ্চিম অংশের কিছু এলাকায় এখনো তারা রয়ে গেছে স্থানীয় সমর্থকদের আশ্রয়ে।
আইএসের মসুল পতনের খবরের সঙ্গে সঙ্গে এই খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে, তাদের খিলাফতের ঘোষিত রাজধানী সিরিয়ার রাকা শহরেও প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। রাকা শহরকে আইএসমুক্ত করতে বহুমুখী আক্রমণ আগের চেয়ে জোরদার হয়েছে; সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, আমেরিকান নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী, মার্কিন-সমর্থিত গ্রুপ সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস, সিরীয় খ্রিষ্টানদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীসহ ছোট-বড় অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইএস একাই লড়ছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, রাকায়ও আইএসের পতন ঘটতে চলেছে। কেউ কেউ বলছেন খুব তাড়াতাড়িই সেটা ঘটবে, কিন্তু অন্যরা বলছেন আরও সময় লাগবে। কারণ, রাকা শহরে প্রায় এক লাখ বেসামরিক মানুষ আটকা পড়েছে; আইএস তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
এই একই সমস্যার কারণে মসুলেও আইএসের পতন ঘটতে অনেক সময় লেগেছে। গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ইরাকি সরকারি সেনাবাহিনী যখন মসুলকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আক্রমণ শুরু করে, তখন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, নতুন বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সাল শুরু হওয়ার আগেই তাঁর সৈন্যরা মুসলকে আইএসের দখল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তা মোটেও সম্ভব হয়নি, মসুলে আইএসের পতন ঘটতে লেগে গেল প্রায় নয় মাস। এর অন্যতম কারণ ছিল মসুল শহরে রয়ে যাওয়া প্রায় দেড় লাখ বেসামরিক মানুষ, যাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। দ্বিতীয়ত, মসুলে যুদ্ধরত এমন অনেক আইএস যোদ্ধা ছিলেন মসুলেরই সন্তান, তাঁদের পরিবার ও জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকেরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন। সে কারণে দেখা গেছে, মসুল যুদ্ধের একদম চূড়ান্ত পর্যায়ে আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর লড়াই হয়েছে গলিতে গলিতে, এমনকি বাড়িতে বাড়িতে।
রাকা শহরের অবস্থাও মসুলের মতোই, কিংবা আইএসের পক্ষে মসুলের চেয়েও বেশি সুবিধাজনক। ওই শহরকে তাদের রাজধানী করার মূল কারণই ছিল এই যে সেখানে তাদের বিপুল জনসমর্থন ছিল। কিন্তু চারদিক থেকে সশস্ত্র শত্রু পরিবেষ্টিত থেকে এবং শত্রুপক্ষের দিক থেকে ক্রমাগত প্রবল আক্রমণের মুখে আইএসের পক্ষে দীর্ঘ সময় তাদের ‘খিলাফত’ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ওপরে উল্লেখিত যেসব কারণে কিংবা যেসব ফ্যাক্টরের জোরে আইএসের বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল, সেই কারণ বা ফ্যাক্টরগুলোর অবসান ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে আইএস আর স্বঘোষিত ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে টিকে থাকতে পারছে না; রাকার পতনের মধ্য দিয়ে তার ‘খিলাফতের’ পতন আসন্ন বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ইসলামিক স্টেট নামের সংগঠনটিরই বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে। না, এ রকম কোনো সম্ভাবনা আপাতত একেবারেই নেই। বরং কিছু আলামত অতি ভয়ংকর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আইএসের অধিকৃত বা নিয়ন্ত্রিত কোনো শহর বা এলাকা আর অবশিষ্ট নেই বলে যদি ধরে নেওয়া হয় যে শান্তি ফিরে এল, তাহলে ভীষণ ভুল করা হবে। কারণ, দেখা যাচ্ছে, যেসব শহর বা এলাকা থেকে তারা দৃশ্যমানভাবে বিতাড়িত হচ্ছে, সেসব শহরে বা এলাকায় তাদের অদৃশ্য অবস্থানের অবসান ঘটছে না। ইউনাইটেড স্টেটস মিলিটারি একাডেমির ‘কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টার’-এর এক সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপের তথ্য হলো, সিরিয়া ও ইরাকের ১৬টি শহর থেকে আইএস যোদ্ধারা বিতাড়িত হওয়ার পরের কয়েক মাসে ওই শহরগুলোতে তারা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে প্রায় দেড় হাজার বার। গবেষক-পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আইএসের স্বঘোষিত রাষ্ট্র বা খিলাফতের চূড়ান্ত পতনের পর এই হামলার আশঙ্কা অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
তখন আইএসকে কী করে সামলানো যাবে?
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।